প্রীতি এবং উদিতা ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। বিকেল বেলা উদিতা এল প্রীতির বাসায়। উদিতা প্রীতির ঠাকুমা এবং মাকে প্রণাম করে জানতে চাইল, প্রীতি কোথায়? প্রীতির মা বললেন, দুপুর থেকেই ও একা ঘরে বসে আছে। কী সব বিষয় নিয়ে ভাবছে। প্রীতির ঘরে এসে উদিতা দেখল সত্যিই তাই। উদিতা কী নিয়ে যেন চিন্তা করছে।
উদিতা : উদিতা, কী ব্যাপার, কী নিয়ে ভাবছ?
প্রীতি : না, তেমন কিছু না। দুপুর থেকেই বেশ কিছু চিন্তা আসছে মাথায়। কিন্তু কোনো উত্তর পাচ্ছি না। কোথায় পাব তাই ভাবছি।
উদিতা : কী চিন্তা আমাকে বলো। তবে তার আগে চলো, মন্দিরে গিয়ে ঠাকুরকে প্রণাম করে আসি। দেখবে মন ভালো হয়ে গেছে।
প্রীতি : তা না হয় গেলাম। কিন্তু যে ভাবনাটা মনে আসছে তা হলো, আমরা বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা এবং আরাধনা করি। কিন্তু এসকল পূজা বা আরাধনার নিয়মসমূহ, আমাদের ধর্মের আরও অন্যান্য বিষয়ে কোনো কিছু জানতে হলে, কোথা থেকে এসব সঠিকভাবে জানতে পারব?
উদিতা : আমিও বিষয়টি সঠিকভাবে তোমাকে বলতে পারব না। আচ্ছা এক কাজ করি চল, আগামীকালের ধর্মের ক্লাসে কেশব স্যারকে জিজ্ঞেস করব। তবে আমি শুনেছি, এসকল বিষয় আমরা হিন্দুধর্মের বিভিন্ন পুস্তকে থেকেও জানতে পারি।
উপরের গল্পে প্রীতির ন্যায় অনেকেই হয়ত আমাদের হিন্দুধর্মের বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চায়। কিন্তু কোথা থেকে সঠিকভাবে বিষয়গুলো জানতে পারবে তা হয়ত জানে না। অনেকের বাড়িতে বা গ্রামের মন্দিরে বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় গ্রন্থ থাকে, আবার অনেকের হয়তো নেই। তাই ধর্ম বিষয়ক কোনো জিজ্ঞাসা থাকলে আমরা সহজেই তার সঠিক উত্তরটি খুঁজে পাইনা। বিশেষ করে বিভিন্ন পূজা এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠান, পার্বণ ইত্যাদি ধর্মীয় নিয়ম অনুসারে পালন, মন্ত্র পাঠ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ধর্মগ্রন্থের প্রয়োজন পড়ে। এবার আমরা হিন্দুধর্মের গুরুত্বপূর্ণ কিছু গ্রন্থ সম্পর্কে জানব।
পৃথিবীর প্রাচীন ধর্মসমূহের মধ্যে হিন্দুধর্ম অন্যতম। ‘হিন্দু” শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। এখানে বহুল প্রচলিত মতটির উল্লেখ করা হচ্ছে। একসময়ে আর্যরা উত্তর-পশ্চিম ভারতের সিন্ধু নদের অববাহিকায় বসবাস করত। প্রাচীন পারস্যবাসীরা ‘স’কে ‘হ’ উচ্চারণ করত। তাদের উচ্চারণে সিন্ধু হয়ে গিয়েছিল হিন্দু। আর এর অববাহিকায় যারা বসবাস করত তাদেরও বলা হতো হিন্দু। এভাবে ঐ অঞ্চলে বসবাসকারী ‘হিন্দু’ নামধারীরা হিন্দু জনগণ এবং হিন্দু সম্প্রদায় নামে পরিচিত হলো। এদের আচরিত ধর্মও হিন্দুধর্ম নামে পরিচিত হলো। পরে এই হিন্দু জনগণ যে স্থানে গিয়েছে সে স্থানও পরিচিত হলো হিন্দুস্থান নামে। হিন্দুধর্মের আরেক নাম সনাতন ধর্ম। সনাতন শব্দটি অনেক প্রাচীন গ্রন্থে পাওয়া যায়। সনাতন শব্দের অর্থ চিরন্তন বা শাশ্বত। অর্থাৎ যা পূর্বে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে তা হলো সনাতন। চিরকালের বক্তব্য ও দর্শন আছে এই ধর্মে। সনাতন ধর্মের বিভিন্ন গ্রন্থে এ ধর্মের বক্তব্য ও দর্শন বর্ণিত আছে।
হিন্দুধর্মের সর্বপ্রাচীন ধর্মগ্রন্থ হলো বেদ। এছাড়া আরও অনেক ধর্মগ্রন্থ রয়েছে। যেমন— উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, পুরাণ, শ্রীশ্রীচণ্ডী প্রভৃতি। সকল ধর্মগ্রন্থেই ঈশ্বরের কথা আছে। তবে এখানে কয়েকটি ধর্মগ্রন্থের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হলো।
হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদ। বেদ শব্দের অর্থ হলো জ্ঞান। বৈদিক যুগে মানুষের চিন্তাভাবনা, দেব-দেবী, ঈশ্বরের ধারণা প্রভৃতি স্থান পেয়েছে বেদে। প্রাচীনকালে জ্ঞানী ব্যক্তিদের বলা হতো ঋষি। এই ঋষিরা ধ্যান করতেন। সাধনা করতেন। এই ধ্যান ও সাধনা থেকে তাঁরা অনেক জ্ঞান অর্জন করেন। এই জ্ঞানের কথা আছে বেদে। বেদে অনেক দেব-দেবীর কথা আছে। এঁদের বলা হয় বৈদিক দেবতা। দেবতাদের মধ্যে আছেন অগ্নি, ইন্দ্র, বায়ু, উষা, সরস্বতী প্রভৃতি।
বেদ প্রথমে অবিভক্ত ছিল। পরবর্তীকালে মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদকে চারভাগে বিভক্ত করেন। যথা— ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ ও অথর্ববেদ। বেদকে বিভক্ত করেছেন বলে মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়নকে বেদব্যাসও বলা হয়ে থাকে। চার বেদের একেকটি ভাগকে সংহিতা বলে।
ঋক্ মানে মন্ত্র। ঋগ্বেদে ঈশ্বরের প্রাকৃতিক সত্তার শক্তিরূপে অনেক দেব-দেবীর গুণকীর্তন বা প্রশংসা ও প্রার্থনামূলক মন্ত্র রয়েছে। মন্ত্রগুলো পদ্যে বা ছন্দে রচিত এক ধরনের কবিতা। মূলত দেব-দেবীর গুণকীর্তন বা প্রশংসামূলক মন্ত্রের সংগ্রহই হলো ঋগ্বেদ। ঋগ্বেদের ঋষিদের মধ্যে বিশ্বামিত্র, মধুছন্দা, বামদেব, গার্গী, ঘোষা, মৈত্রেয়ী প্রমুখ বিখ্যাত।
সাম মানে গান। যে মন্ত্র সুর দিয়ে গানের মাধ্যমে প্রকাশ করা যায় তাকেই বলা হয় সাম। যে বেদে এ ধরনের মন্ত্র স্থান পেয়েছে তা সামবেদ। সামবেদের অধিকাংশ মন্ত্র ঋগ্বেদ সংহিতা থেকে নেওয়া হয়েছে।
ঋক্ ও সাম ব্যতীত অবশিষ্ট বেদমন্ত্রসমূহই যজুঃ নামে পরিচিত। যজুঃ মানে যজ্ঞ। যজ্ঞের অধিকাংশ নিয়ম এবং কার্যপ্রণালী যজুর্বেদে বর্ণিত হয়েছে। যজ্ঞের সঙ্গে যে বেদের মন্ত্রের গভীর সম্পর্ক তা-ই যজুর্বেদ। যজুর্বেদের মন্ত্রসমূহ গদ্য ও পদ্যে রচিত। এটি কৃষ্ণ যজুর্বেদ ও শুক্ল যজুর্বেদ নামে দুই ভাগে বিভক্ত।
বেদের চতুর্থভাগ হচ্ছে অথর্ববেদ। অথর্ববেদকে প্রাচীন চিকিৎসা বিজ্ঞানের উৎস বলা যায়। এখানে নানা প্রকার রোগব্যাধি এবং সেগুলো প্রতিকারের উপায় সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে। রোগ নিরাময়ের উপায়স্বরূপ নানাপ্রকার বৃক্ষ, লতা-পাতা, গুল্ম প্রভৃতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আয়ুর্বেদ নামক যে চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে তারও আদি উৎস এই অথর্ববেদ। এ ছাড়া অস্থিবিদ্যা, বাস্তুবিদ্যা, শল্যবিদ্যা প্রভৃতি সম্পর্কে এ বেদে উল্লেখ রয়েছে।
বেদ পরবর্তী ব্রাহ্মণ ও আরণ্যকের শেষ অংশ হলো উপনিষদ। উপনিষদ বেদান্ত নামেও অভিহিত হয়ে থাকে। বেদান্ত শব্দের অর্থ হলো বেদের অন্ত বা শেষভাগ। উপনিষদ শব্দের একটি অর্থ, গুরুর নিকটে বসে নিশ্চয়ের সঙ্গে যে জ্ঞান অর্জন করা হয় তাই উপনিষদ। উপনিষদের আলোচ্য বিষয় হলো ব্রহ্ম। এখানে নিরাকার ঈশ্বরের কথা বলা হয়েছে। উপনিষদে স্পষ্ট উল্লেখ আছে— এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মূলে আছেন একমাত্র ব্রহ্ম। তিনি সত্য ও চৈতন্যময়। এছাড়া আর যা কিছু রয়েছে সবই অসত্য ও জড়। সুতরাং ব্রহ্মপ্রাপ্তি হচ্ছে জীবের একমাত্র লক্ষ্য।
জীবের মূল সত্তা তার আত্মা। এই আত্মা হচ্ছে পরমাত্মা বা ব্রহ্মেরই অংশ। এই ব্রহ্ম নিরাকার। আত্মারূপে তিনি জীবের মধ্যে অবস্থান করে থাকেন। সুতরাং জীব ব্রহ্ম ছাড়া আর কিছুই নয়। এই ব্রহ্মজ্ঞানই হলো উপনিষদের বিষয়বস্তু। এই আত্মার কোনো বিনাশ নেই। উপনিষদের সংখ্যা অনেক। তবে বারটি উপনিষদ প্রধান উপনিষদ হিসেবে স্বীকৃত। এ উপনিষদগুলো হলো— ঈশ, কেন, কঠ, প্রশ্ন, মুণ্ডক, মাণ্ডুক্য, ছান্দোগ্য, তৈত্তিরীয়, ঐতরেয়, শ্বেতাশ্বতর, বৃহদারণ্যক ও কৌষিকী।
প্রাচীন ভারতীয় সূর্যবংশীয় রাজাদের কাহিনি নিয়ে রামায়ণ রচিত। এর রচয়িতা মহর্ষি বাল্মীকি। এটি সংস্কৃত ভাষায় রচিত একটি মহাকাব্য। অযোধ্যার রাজা দশরথের পুত্র রামচন্দ্রের জীবন-কাহিনি এর মুখ্য বিষয়। এতে রামের কাহিনি থাকায় এর নাম হয়েছে রামায়ণ। বিষ্ণুর দশাবতারের একটি হচ্ছে রাম। তাই হিন্দুধর্মে রামের কাহিনি নির্ভর ‘রামায়ণ' পবিত্র ধর্মগ্রন্থ হিসেবে মর্যাদা পেয়ে থাকে। সমগ্র রামায়ণকে সাতটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রত্যেকটি ভাগকে কাণ্ড বলা হয়। কাণ্ডগুলো হলো : (১) আদি (২) অযোধ্যা (৩) অরণ্য (৪) কিষ্কিন্ধ্যা (৫) সুন্দর (৬) যুদ্ধ এবং (৭) উত্তর কাণ্ড। রামায়ণে চব্বিশ হাজার শ্লোক রয়েছে ।
অযোধ্যার রাজা ছিলেন দশরথ। তাঁর চার পুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠপুত্র রামচন্দ্রের জীবন-কাহিনি এ গ্রন্থের মুখ্য বিষয়। রাজা দশরথের তিন স্ত্রী—কৌশল্যা, কৈকেয়ী ও সুমিত্রা। কৌশল্যার পুত্র রাম, কৈকেয়ীর পুত্র ভরত, সুমিত্রার পুত্র লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্ন। রাজা দশরথ জ্যেষ্ঠপুত্র রামচন্দ্রকে যুবরাজ হিসেবে অভিষিক্ত করার ইচ্ছা পোষণ করেন। কিন্তু দাসী মন্থরার কুপরামর্শে প্ররোচিত হয়ে কৈকেয়ী দশরথের কাছে দুটি বর চান। কারণ দশরথ কৈকেয়ীর কাছে পূর্বে বর দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তাই রামের যুবরাজ হিসেবে অভিষেক হওয়ার কথা শুনে কৈকেয়ী দুটি বর দশরথের কাছে প্রার্থনা করেন। প্রথম বর হলো রামের চৌদ্দ বছর বনবাস আর দ্বিতীয়টি হলো ভরতের রাজ্যাভিষেক। রাম পিতৃসত্য পালনের জন্য বনে চলে গেলেন। রামের শোকে দশরথ মারা গেলেন। বনবাস সময়ে লঙ্কার রাজা রাবণ সীতাকে অপহরণ করেন। বানর সেনাদের নিয়ে রাম লঙ্কা আক্রমণ করেন।
রাবণকে পরাজিত করে রাম সীতাকে উদ্ধার করে অযোধ্যায় ফিরিয়ে আনলেন। সীতা দীর্ঘ দিন লঙ্কায় বন্দী থাকায় অনেক প্রজা অযোধ্যার রানী হিসেবে তাঁকে মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। অবশেষে প্রজাদের ইচ্ছা পূরণের জন্য রামচন্দ্র সীতাকে পুণরায় বনবাসে পাঠালেন। সেখানে বাল্মীকি মুনির আশ্রমে সীতা আশ্রয় পেলেন। বনবাসে যাওয়ার সময় সীতা সন্তান-সম্ভবা ছিলেন। আশ্রমে যাওয়ার পর সীতা লব ও কুশ নামে দুটি যমজ সন্তান জন্ম দিলেন। বারো বছর পর বনবাস শেষে সীতা লব ও কুশকে নিয়ে অযোধ্যায় ফিরে এসেছিলেন।
এখানে রামায়ণের কাহিনিটি সংক্ষেপে বর্ণনা করা হয়েছে। বিষ্ণুর অবতার হিসেবে রামের অসংখ্য গুণাবলি তার বিভিন্ন কার্যাবলির মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। এখানে আমরা রামকে একজন পিতৃভক্ত সন্তান, প্রজাবৎসল রাজা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সফল বীর, ন্যায় এবং সত্যের প্রতীক হিসেবে দেখতে পাই। আমরা নিশ্চয়ই রামের এই গুণাবলি অর্জন করে আমাদের জীবনে সেগুলোর প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা করব।
মহাভারত একটি বিশাল ঐতিহাসিক গ্রন্থ। হিন্দুদের কাছে মহাভারত ধর্মীয়গ্রন্থ হিসেবে গৃহীত। এটি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন সংস্কৃত ভাষায় রচনা করেছেন। তিনি ব্যাসদেব নামে পরিচিত। কুরু-পাণ্ডবদের মধ্যে বিদ্বেষ এবং কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের মাধ্যমে পাণ্ডবদের জয়লাভ মহাভারতের মূল কাহিনি। এই কাহিনির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনেক উপকাহিনি। মহাভারতে মোট আঠারোটি পর্ব রয়েছে।
হস্তিনাপুর নামে একটি রাজ্য ছিল। সেখানকার রাজা ছিলেন চন্দ্রবংশীয় শান্তনু। রাজা শান্তনুর তিন পুত্র ছিল—দেবব্রত, চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য। জ্যেষ্ঠ দেবব্রত বিয়ে করবেন না এবং সিংহাসনেও বসবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। এই প্রতিজ্ঞার জন্য তাঁর নাম হয় ভীষ্ম। চিত্রাঙ্গদের অকাল মৃত্যু হয়। তাই বিচিত্রবীর্য রাজা হন। তাঁর দুই পুত্র –ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু। ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ ছিলেন, তাই পাণ্ডু রাজা হন। পাণ্ডুর মৃত্যুর পর যুধিষ্ঠিরের রাজা হওয়ার কথা। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ তা মেনে নিতে পারেননি। আর তখন থেকেই শুরু হয় বিবাদ। এঁরা সকলেই কুরু রাজার বংশধর বিধায় কৌরব বলা হয়। কিন্তু পাণ্ডুর সন্তানরা ক্রমে পাণ্ডব হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র দুর্যোধন অনেকবার পাণ্ডবদের মেরে ফেলার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁরা রক্ষা পেয়ে যান। পাণ্ডবদের রাজ্যছাড়া করার জন্য দুর্যোধন মামা শকুনিকে নিয়ে তাঁদেরকে পাশা খেলায় আহ্বান করেন। পাণ্ডবরা পাশা খেলায় পরাজিত হন এবং শর্ত অনুযায়ী বনবাসে যান। কিন্তু পাণ্ডবরা ফিরে এলে দুর্যোধন তাঁদের রাজ্য ফিরিয়ে দিতে অস্বীকার করেন। তখন শ্রীকৃষ্ণ উভয় পক্ষের মধ্যে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করেন। কিন্তু দুর্যোধন তা মেনে নেয়নি। আর তখনই শুরু হয়ে যায় উভয়পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ। এটি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ নামে পরিচিত। আঠারো দিনব্যাপী কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হয়। দুর্যোধনরা পরাজিত হয়। ধর্মের জয় হলো আর অধর্মের পরাজয় হলো।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থ হলো শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা। শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত অমৃতময় বাণী হলো গীতা। তৃতীয় পাণ্ডব বীরশ্রেষ্ঠ অর্জুনের সঙ্গে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময়ে কথোপকথনের পটভূমি হলো এই গীতাগ্রন্থ। তাঁদের এই কথোপকথনের মধ্য দিয়ে ধর্ম, দর্শন, নৈতিকতা, রাজনীতি, সমাজনীতি, গার্হস্থ্যনীতি ইত্যাদি সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। গীতা হলো সকল শাস্ত্রের সারগ্রন্থ। গীতা মানুষকে ধৈর্যশীল, সংযমী, নিরহংকার হতে উপদেশ প্রদান করে। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা মহাভারতের ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত। গীতা গ্রন্থে আঠারোটি অধ্যায় এবং সাতশত শ্লোক রয়েছে। এজন্য গীতাকে সপ্তশতী বলা হয়।
কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ যখন শুরু হবে, তখন দুপক্ষের আপনজনদের দেখে মহাবীর অর্জুন খুব বিষণ্ণ ও মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তিনি কাকে আঘাত করবেন। সকলেই যে তার প্রিয়জন। তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে কর্ম, জ্ঞান, ভক্তি, মোক্ষ বিষয়ে নানা উপদেশ দিলেন। তিনি বলেন, আত্মা জন্মরহিত, মৃত্যুহীন; আত্মাকে কোনোরূপইে ধ্বংস করা যায় না। জীবের মধ্যে আত্মা অবস্থান করে। তাই মৃত্যুর মাধ্যমে দেহের ধ্বংস হলেও আত্মার ধ্বংস হয় না। তাই ধর্মের জন্য যুদ্ধ করা এবং অধর্মের পরাজয়ের জন্য অর্জুনের যুদ্ধ করা একান্ত কর্তব্য।
হিন্দুধর্মাবলম্বীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হলো শ্রীশ্রীচণ্ডী। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে দেবী চণ্ডী বা দেবীর মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। শ্রীশ্রীচণ্ডী মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত। চণ্ডীতে সাতশত শ্লোক রয়েছে। এর জন্য একে সপ্তশতীও বলা হয়। মার্কণ্ডেয় পুরাণের বিষয়বস্তু অবলম্বনে শ্রীশ্রীচণ্ডী রচিত হলেও বিষয়বস্তু ও রচনার গুণে এটি আলাদা গ্রন্থের মর্যাদা পেয়েছে। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্যের কাহিনি, দেবী মহামায়াসহ নানা কাহিনির উদ্ভব ও মহিমা বর্ণিত হয়েছে। সাধারণত দুর্গাপূজা ও বাসন্তীপূজায় চণ্ডী পাঠ করা হয়। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার মতো চণ্ডীও প্রতিদিন পাঠ করা যায়।
দেবী দুর্গা ও মহিষাসুরের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মহিষাসুরকে পরাজিত করে দেবী দুর্গা দেবতাদের মুক্ত করেন। দেবতারা তাঁদের স্বর্গরাজ্য ফিরে পান। স্বর্গ ফিরে পেয়ে তাঁরা আনন্দিত হলেন।
তাঁরা দেবীর জয়গান ও স্তব-স্তুতিতে চারদিক মুখরিত করে তোলেন।
সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থসাধিকে
শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরি নারায়ণি নমোহস্তু তে ।। (১১/১০)
সর্ব-মঙ্গল-মঙ্গল্যে - সকল মঙ্গলের মঙ্গলস্বরূপা, শিবে - শিবা বা কল্যাণী, সর্বার্থসাধিকে - সৰ্ব অর্থসাধিকা বা সকল সিদ্ধিদাত্রী অথবা সকল ফলদাত্রী, শরণ্যে - আশ্রয়দাত্রী, ত্র্যম্বকে (ত্রি+অম্বকে) - তিন চোখ (অম্বক) বা ত্রি নয়নবিশিষ্টা, গৌরি - গৌরী (গৌরবর্ণা), নারায়ণি - নারায়ণী, নমোহস্তু (নমঃ+অস্তু) - নমস্কার করি, - তে - তোমাকে ।
সরলার্থ: হে নারায়ণী, হে গৌরী, তুমি সকল মঙ্গলের মঙ্গলস্বরূপা, কল্যাণদায়িনী, সকল প্রকার সুফল প্রদায়িনী, আশ্রয়স্বরূপা, ত্রিনয়না তোমাকে বারবার নমস্কার জানাই।
আরও দেখুন...